পানাম নগর, সোনারগাঁও : বাংলার ঐতিহ্যের শহর

পানাম নগর,সোনারগাঁও : বাংলার ঐতিহ্যের শহর…
বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ উপজেলায় অবস্থিত পানাম নগর, একটি ঐতিহাসিক স্থান যা বাংলার সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের অন্যতম প্রতিচ্ছবি। মুঘল ও ব্রিটিশ উপনিবেশিক যুগের স্থাপত্যশৈলীর অপূর্ব সংমিশ্রণে গঠিত এই শহরটি একসময় বাংলার অন্যতম সমৃদ্ধশালী বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। আজ এটি পর্যটকদের জন্য এক আকর্ষণীয় স্থান এবং বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
পানাম সিটির ইতিহাস:
পানাম সিটি মূলত ১৫শ শতকের দিকে গড়ে ওঠে, তখন বাংলার রাজধানী ছিল সোনারগাঁ। এটি মুঘল আমলে (১৫৭৬-১৭৫৭) একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীতে ব্রিটিশ শাসনামলে (১৭৫৭-১৯৪৭) এটি আরও উন্নত হয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। মূলত, পানাম নগরী ছিল ধনী হিন্দু ব্যবসায়ীদের আবাসস্থল, যারা সূতিবস্ত্রের ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৫ সালের দাঙ্গার পর বহু ব্যবসায়ী এলাকা ছেড়ে চলে গেলে পানাম নগরী প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে যায়।
পানাম নগরীর স্থাপত্যশৈলী:
- পানাম নগরীর ভবনগুলোর স্থাপত্যশৈলী এক অনন্য ঐতিহ্য বহন করে। এখানে মুঘল, ব্রিটিশ এবং বাংলার ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যশিল্পের সংমিশ্রণ স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। প্রতিটি ভবনের নির্মাণশৈলীতে সূক্ষ্ম কারুকার্য, পোড়ামাটির অলঙ্করণ, খোদাই করা দরজা-জানালা এবং সুনিপুণ অলংকরণ রয়েছে।
- এই নগরীর রাস্তাগুলো সরু এবং পাথর বাঁধানো, যা অতীতের একটি জীবন্ত চিত্র তুলে ধরে। ভবনগুলোর অধিকাংশই দুই তলা বিশিষ্ট, যেখানে প্রশস্ত বারান্দা, খিলানযুক্ত জানালা ও সুচারুভাবে নকশা করা ছাদ বিদ্যমান। ভবনগুলোর দেয়ালে উঁচু অলংকৃত খোদাই এবং লতাপাতা নকশা দেখা যায়, যা সেসময়ের কারিগরদের দক্ষতার পরিচায়ক।
- বিশেষ করে পানাম নগরীর প্রবেশদ্বার দুটি, যা একসময় রক্ষীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো, এখনো সেসময়ের স্থাপত্য রীতির প্রমাণ বহন করে। ভবনগুলোর সামনের অংশে বিস্তৃত খোলা উঠোন ও প্রশস্ত প্রবেশপথ রয়েছে, যা সেসময়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রীতির অংশ ছিল।
পানাম নগরীর গুরুত্ব ও বর্তমান অবস্থা:
একসময়কার সমৃদ্ধ এই নগরী আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত। ১৯৬৫ সালে দাঙ্গার পর হিন্দু ব্যবসায়ীরা ভারত চলে গেলে এটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। বর্তমানে পানাম নগরী প্রত্নতাত্ত্বিক সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অধীনে রয়েছে এবং এটি বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ২০০৬ সালে ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ড (WMF) এটিকে বিশ্বের ১০০ বিপন্ন ঐতিহাসিক স্থানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। তবে পরিবেশগত ও মানবসৃষ্ট নানা সমস্যার কারণে নগরীর স্থাপত্য অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
*কেন ঘুরে আসবেন পানাম নগরী?
১. ঐতিহাসিক স্থাপত্য: মুঘল ও ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য সংমিশ্রণ দেখা যায় এখানে।
২. ছবির মতো পরিবেশ: ফটোগ্রাফির জন্য আদর্শ স্থান।
৩. বাংলার ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি: বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।
৪. অপূর্ব পরিবেশ: নীরব, শান্ত পরিবেশ যা দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে।
*কিভাবে যাবেন পানাম নগরী?
- ঢাকা থেকে সোনারগাঁ পৌঁছানো বেশ সহজ। গুলিস্তান থেকে লোকাল বা এসি বাসে করে মোগরাপাড়া চৌরাস্তা যেতে হবে, সেখান থেকে রিকশা বা অটোরিকশায় সহজেই পানাম নগরী পৌঁছানো যায়।
শেষ কথা:
পানাম নগরী শুধুমাত্র একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়, এটি বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। এটি সংরক্ষণ করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকার এটিকে পর্যটন এলাকা হিসেবে ঘোষণার উদ্যোগ নেয়। যদি ইতিহাস ভালোবাসেন, তবে সময় করে একদিন ঘুরে আসতে পারেন এই অনন্য স্থানে।
Share this content: